পরিচ্ছেদ : দুই ( জ্ঞানের বিষয়ে, বিচারিক রায দেওয়া, ভালোর আদেশ করা ও খারাপকে নিষেধ করা)


জ্ঞানের বিষয়ে

জ্ঞান হচ্ছে প্রত্যেক উন্নত আধ্যাত্মিক অবস্থার ভিত্তি এবং প্রত্যেক উঁচু মাক্বামের পূর্ণতা।এ কারণে পবিত্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য জ্ঞান সন্ধান করা বাধ্যতামূলক - তা হলো তাক্বওয়া (সতর্কতা) অবলম্বনের জন্য জ্ঞান এবং ইয়াক্বিন (নিশ্চিত জ্ঞান)।  হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন,জ্ঞান সন্ধান করো যদি তা চীনেও হয়। অর্থাৎ নিজের সত্তা সম্পর্কে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ভিতরেই লুকায়িত আছে মহান প্রভু সম্পর্কে জ্ঞান। পবিত্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন,যে ব্যক্তি তার নিজ সম্পর্কে জানে সে তার রবকে জানে। এছাড়া তোমাদের উচিত সে জ্ঞান অর্জন করা যা ছাড়া কোন কাজই সঠিক নয় এবং তা হচ্ছে (ইখলাস) আন্তরিকতা। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে আশ্রয় নেই সেই জ্ঞান থেকে যার কোন উপকারিতা নেই তাহলো সেই জ্ঞান যা ইখলাসের সাথে কৃত কাজের পরিপন্থী।

জেনে রাখো সামান্য পরিমাণ জ্ঞানের জন্য বিরাট পরিমাণ কাজ দরকার, কারণ ক্বিয়ামত সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য - যে ব্যক্তির এ জ্ঞান হয়েছে - তার সারা জীবন সে অনুযায়ী কাজ করে যেতে হয়। ঈসা (আঃ) বলেছেন, আমি একটি পাথর দেখলাম যাতে লেখা ছিলআমাকে উল্টিয়ে দাও তাই আমি তা উল্টিয়ে দিলাম।অন্য পিঠে লেখা ছিলঃ যে ব্যক্তি - সে যা জানে তা অনুযায়ী কাজ করে না, সে ধ্বংস হয়ে যাবে সে যা জানে না তা খুঁজতে গিয়ে এবং তার নিজের জ্ঞান তার বিরুদ্ধে যাবে ।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা দাউদ (আঃ) কে সংবাদ পাঠালেন, যে ব্যক্তির জ্ঞান আছে কিন্তু সে তার জ্ঞান অনুয়ায়ী কাজ করে না তার সাথে আমি ন্যূনতম আচরণ যা করবো তা সত্তরটি বাতেনী শাস্তির চেয়েও খারাপ, তা হলো তার অন্তর থেকে আমর স্মরণের মিষ্টতা দূর করে দিবো। জ্ঞানের মাধ্যম ছাড়া আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার দিকে কোন পথ নেই এবং জ্ঞান হচ্ছে একজন মানুষের সাজপোশাক - এই পৃথিবীতে ও আখেরাতে, বেহেশতের দিকে তার চালক এবং এর মাধ্যমে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।

সেই সত্যিকারভাবে জানে- যার ভেতরে পরিশুদ্ধ আচরণ, বিশুদ্ধ দোয়া, সত্যবাদিতা এবং তাক্বওয়া (সতর্কতা) কথা বলে; তার জিহবা, তার বিতর্ক, তার তুলনা এবং দাবীগুলো নয়। এছাড়া, অন্য সময়ে যারা জ্ঞান সন্ধান করেছে তাদের ছিলো বুদ্ধি, ধার্মিকতা, প্রজ্ঞা, বিনয়, তাক্বওয়া  ও  সতর্কতা  , কিন্তু আজকাল আমরা দেখি যারা তা সন্ধান করে তাদের মধ্যে এধরণের কোন গুণাবলী নেই।জ্ঞানী ব্যক্তির প্রয়োজন বুদ্ধি, দয়া-মায়া, সৎ উপদেশ, সহ্যশক্তি, ধৈর্য্, সন্তুষ্টি এবং উদারতা । যে জানতে চায় তার প্রয়োজন জ্ঞানের জন্য আকাঙ্খা, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, আত্মনিয়োগ (তার সময় ও কর্মশক্তি), ধার্মিকতা, তাক্বওয়া (সতর্কতা) , স্মরণশক্তি এবং দৃঢ়তা।

বিচারিক রায় দেওয়া

বিচারিক রায় দেওয়া তার জন্য অনুমোদিত নয় যাকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বাতেনী পবিত্রতা, তার গোপণ ও প্রকাশ্য কাজে ইখলাস ও প্রত্যেক হালে (অবস্থায়) একটি প্রমাণ দান করেন নি।এর কারণ হলো যে ব্যক্তি বিচারিক রায় দিলো সে আইনগত সিদ্ধান্ত দিল এবং আইনগত সিদ্ধান্ত শুধু তখনই সিদ্ধ হয় যখন তা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অনুমোতিতে এবং তাঁর প্রমাণের মাধ্যমে হয়। যে তার  বিচারিক রায়তে যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই উদার, সে অজ্ঞ-মূর্খ এবং তাকে তার মূর্খতার জন্য শাস্তি দেওয়া হবে এবং তার বিচারিক রায় তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে-যেভাবে  হাদিসে এর ইঙ্গিত রয়েছে।জ্ঞান হচ্ছে একটি আলো (নূর) যা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর যাকে ইচ্ছা তা হৃদয়ে দান করেন।

পবিত্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে তোমাদের মধ্যে বিচারিক রায় দেওয়ার বিষয়ে সবচেয়ে দুঃসাহসী সে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার প্রতি সবচেয়ে বেআদব। বিচারক কি জানে না যে সে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ও তাঁর দাসদের মাঝে হস্তক্ষেপ করেছে এবং সে জান্নাত ও আগুনের মাঝে দুলছে? সুফিয়ান ইবনে উইয়াইনাহ বলেছিলোঃ কীভাবে অন্য কেউ আমার জ্ঞান থেকে লাভবান হতে পারে যদি আমি নিজেকে তার উপকারিতা থেকে বঞ্চিত রাখি? কোন ব্যক্তির জন্য সঠিক নয় যে সে সৃষ্টির মধ্যে হালাল ও হারাম সম্পর্কে বিচারিক রায় দিবে, শুধু সেই ব্যক্তি ছাড়া যে তার সময়ের জনগণকে, তার গ্রাম, তার শহরকে রাসূল (সাঃ)- এর আনুগত্যের মাধ্যমে সত্যের অনুসারী করে যে জানে তার বিচারিক রায়ের কোন বিষয়টি প্রয়োগযোগ্য।রাসূল (সাঃ)বলেছেন, বিচারিক রায় দেওয়া এমন একটি বিরাট বিষয় যে সেখানে,আশা করা যায়,সম্ভবত এবং হয়তোবা-র কোন স্থান নেই।

বিশ্বাসীদের আমীর হযরত আলী (রাঃ) একজন বিচারককে বলেছিলেনঃ তুমি কি কোরআনের কোন্ আয়াত রহিতকারী এবং কোন আয়াত রহিত হয়েছে তার মধ্যে পার্থক্য¨, জানো?

-না

- কোরআনের উদাহরণগুলোর মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তোমার ভাল দখল আছে?

-না

-তাহলে তুমি ধ্বংস হয়ে গেছো এবং অন্যদের ধ্বংস করেছো।

একজন বিচারকের জন্য জানা প্রয়োজন কোরআনের বিভিন্ন অর্থৃ, রাসূল (সাঃ)-এর পথের সত্য, বাতেনী ইঙ্গিত, ভদ্রতা, ঐক্যমত ও ভিন্নমত এবং তারা যে বিষয়ে একমত ও ভিন্নমত সে সম্পর্কে পিরিচিত থাকা।এরপর তার থাকা উচিত সুক্ষ্ম পার্থক্য, ¨ বোঝার ক্ষমতা, শুদ্ধ আচরণ, প্রজ্ঞা এবং সতর্কতা। যদি তার এগুলো থাকে, তাহলে তাকে বিচার করতে দাও।

 ভালোর আদেশ করা ও খারাপকে নিষেধ করা

যে ব্যক্তি তার দুঃচিন্তা ছুঁড়ে ফেলে নি, তার নিজের সত্তার খারাপ ও তার ক্ষুধা থেকে পবিত্র হয়নি, শয়তানকে পরাজিত করেনি এবং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার বেলায়েতের অধীনে এবং তার নিরাপত্তার ভেতরে প্রবেশ করেনি সে যথাযথভাবে ভালোর আদেশ এবং খারাপকে যথাযথভাবে নিষেধ করতে অক্ষম এবং যেহেতু সে উল্লেখিত গুণাবলী অর্জন করতে পারেনি, সে ভালোর আদেশ ও খারাপকে নিষেধ করার জন্য যে পদক্ষেপই গ্রহন করুক তা তার বিরুদ্ধে যাবে এবং জনগণ তা থেকে কোন উপকার লাভ করবে না। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছে,¨কী? তোমরা কি জনগণকে ভালো হওয়ার আদেশ দাও ও নিজেদের সত্তাকে অবহেলা করো অথচ তোমারা কোরআন পড়ছো, তোমরা কি বুঝ না?" ( সূরা বাকারা: ৪৪)

যে তা করে তাকে ডেকে বলা হয়: " হে  বিশ্বাসঘাতক, তুমি কি আমার সৃষ্টি থেকে তা দাবী করো যা তুমি নিজে প্রত্যাখ্যান করেছো এবং নিজের উপর লাগামকে (এ বিষয়ে) ঢিল দিয়েছো?"

বর্ণিত আছে যে আলাবা আল আসাদি রাসুলুল্লাহকে (সাঃ) এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে; " হে যারা বিশ্বাস করো, নিজেদের সত্তার যত্ম নাও; যে ভুল করে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না যখন তোমরা সঠিক পথে আছো।" ( সূরা মায়িদা : ১০৫)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, " ভালোর আদেশ দাও এবং খারাপকে নিষেধ করো এবং যে ক্ষতি তোমাদের স্পর্শ করে তা সহ্য করো, ঐ সময় পর্যন্ত যখন তোমরা দেখতে পাও নীচতাকে মেনে চলা হচ্ছে, আবেগকে অনুসরণ করা হচ্ছে এবং যখন প্রত্যেকেই তার নিজের মতামতকে বড় করে দেখবে, তখন তোমরা শুধু নিজেদের বিষয়ে মনোযোগ দাও এবং সাধারণ জনগণের বিষয়গুলো উপেক্ষা করো।"

যে ব্যক্তি ভালোর আদেশ দেয় তার জানা দরকার কী অনুমোদিত এবং কি নিষিদ্ধ; অবশ্যই সে যেন সে বিষয়ে নিজের পছন্দ-অপছন্দ থেকে মুক্ত থাকে যখন সে ভালোর আদেশ দেয়, জনগণকে ভালো উপদেশ দেয়, যেন তাদের প্রতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু হয় এবং তাদের নরমভাবে ও পরিষ্কারভাবে আহবান করে এবং সেই পথে তাদের বিভিন্ন চরিত্র সম্পর্কেও খেয়াল রাখে, যেন সে প্রত্যেককে তার যথাযথ স্থানে রাখতে পারে।

তাকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে নফসের চালাকি এবং শয়তানের ফাঁদ- এর দেকে। তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে যদি কোন বিপদ আপদ আসে এবং যে বিষয়ে সে তাদেরকে উপদেশ দেয় সে বিষয়ে অবশ্যই সে জনগণের কাছ থেকে তার কোন প্রতিদান নেবে না, না তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। সে অবশ্যই আক্রমণাত্বক ও আবেগপূর্ণ হবে না। সে নিজের জন্য রাগান্বিত হবে না। সে অবশ্যই নিজের নিয়তকে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার জন্য স্থির করবে এবং তাঁর সাহায্য চাইবে এবং তাকেই চাইবে। কিন্তু যদি জনগণ তার বিরোধিতা করে এবং তার প্রতি কর্কশ আচরণ করে তাহলে তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে এবং যদি তারা তার সাথে একমত হয় এবং তার মতামতকে গ্রহন করে, তাহলে তাকে অবশ্যই কৃতজ্ঞ হতে হবে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে, তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং সে নিজের ক্রটিগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবে।





Reactions

Post a Comment

0 Comments