পরিচ্ছদ : চার ( পোষাক, লোক দেখানো, সত্যবাদিতা, ইখলাস)


পোষাক

বিশ্বাসীর পোষাকের শ্রেষ্ঠ অলংকার হচ্ছে তাক্বওয়া (সতর্কতা) এবং সবচেয়ে বেশি রহমত প্রাপ্ত পোষাক হচ্ছে ঈমান। যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন,  এবং যে পোষাক পাহারা দেয় (অন্যায়ের বিরুদ্ধে); তা সর্বোত্তম।( সূরা আরাফ : ২৬)

বাইরের পোষাক আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছ থেকে একটি নেয়ামত যা আদমের সন্তানদের ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য দেয়া হয়েছে; এটি সম্মানের একটি চিহ্ন যা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আদমের বংশধরদের দিয়েছেন। তিনি এ সম্মান অন্য কোন প্রাণীকে দেন নি। এটি বিশ্বাসীদের দেওয়া হয়েছে তাদের দায়িত্ব পালনের একটি মাধ্যম হিসেবে। তোমার শ্রেষ্ঠ পোষাকগুলো হচ্ছে সেগুলো যা তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয় না, যে পোষাকগুলো প্রকৃতপক্ষে তোমাকে আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা এবং আনুগত্যের কাছে আনে, যেগুলো তোমাকে পরিচালিত করে না অহংকার, ধোঁকা, কপটতা, গর্ব অথবা দাম্ভিকতার দিকে; কারণ এ গুলো ধ্বংসকারী দুর্যোগ এবং এসবের পরিণতি হচ্ছে হৃদয়ের কাঠিন্য।

যখন তুমি তোমার পোষাক পরবে তখন স্মরণ করো যে আল্লাহ তাঁর রহমত দিয়ে তোমার ভুল কাজগুলো ঢেকে দেন। তোমার উচিত তোমার ভেতরের অংশকে ঢেকে দেয়া যেভাবে তুমি তোমার পোষাক দিয়ে বাইরের অংশকে ঢেকে দিচ্ছো। তোমার ভিতরের সত্য ঢেকে যাক আনুগত্যে। আল্লাহর উপচে পড়া নেয়ামতকে স্মরণ রাখো। যেহেতু তিনি শারীরিক ভদ্রতা ঢাকতে পোষাক তৈরির উপায় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন এবং দরজা খুলে দিয়েছেন তওবা, অনুতাপ ও সাহায্য প্রার্থনার জন্য, যেন ভিতরের অংশ এবং সেগুলোর ভুল কাজ ও খারাপ চরিত্রকে ঢেকে দিতে পারেন।

অন্যের দোষ প্রকাশ করে দিও না যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তোমার ভিতরে এর চেয়ে খারাপ জিনিষ গোপন করেছেন। নিজের ত্রুটিগুলো নিয়ে চিন্তা করো এবং সে বিষয় ও পরিস্থিতিগুলো উপেক্ষা করো যা তোমার সাথে সম্পর্কিত নয়। সাবধান থাকো হয়তো তুমি অন্যের কাজকর্মের বিষয়ে নিজের জীবনকে খরচ করে ফেলবে এবং তোমাকে দানকৃত অপূরণীয় সম্পদ অন্যের সাথে বিনিময় করে ফেলবে; আর এভাবে নিজেকে ধ্বংস করবে। অন্যায় কাজগুলোকে ভুলে যাওয়া আল্লাহর সবচেয়ে বড় শাস্তি আনে এ পৃথিবীতে এবং আখিরাতে তা হয় শাস্তির প্রধান কারণ। যতক্ষণ বান্দাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালকে মেনে চলায় ব্যস্ত থাকে, নিজের দোষগুলো স্বিকার করে এবং আল্লাহু সুবহনাহু ওয়া তায়ালার প্রতি ঈমান কমে যাবে এমন জিনিস পরিত্যাগ করে তখন সে ধ্বংস থেকে রক্ষা পায় এবং সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের সমুদ্রে নিমজ্জিত হয় এবং প্রজ্ঞা ও স্বচ্ছ জ্ঞানের মুক্তা ও উপকারীতা লাভ করে।

কিন্তু যখন সে তার নিজের অন্যায় কাজগুলো ভুলে যায় এবং নিজের ত্রুটিগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং তার ক্ষমতা ও শক্তিতে পিছিয়ে পড়ে, সে কখনো সফল হবে না।

লোক দেখানো (রিয়া)

নেজের কাজকে এমন কাউকে দেখিও না যে না পারে জীবন দিতে, আর না পারে মৃত্যু দিতে এবং যে তোমার বোঝা নিতে পারে না। লোক দেখানো হলো একটি গাছ যার ফল হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে অন্য খোদাদের গোপনে শরীক করা এবং এর শিকড় হচ্ছে মোনাফেক্বী। বিচার দিনে মোনাফেক্বকে বলা হবে: তোমার কাজের পুরস্কার যা তুমি মনে করো তা নাও তাদের কাছ থেকে যাদেরকে তুমি আমার অংশীদার হিসেবে নিয়েছিলে। তাদের কাছে চাও যাদের ইবাদত তুমি করেছিলে এবং ডেকেছিলে, যাদের কাছ থেকে তুমি আশা করেছিলে এবং যাদেরকে তুমি ভয় করতে। জেনে রাখো তোমার ভিতরের কোন কিছু আল্লাহর কাছ থেকে লুকাতে পারো না, তুমি প্রতারিত হবে তোমাকে দিয়েই। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, তারা ধোঁকা দিতে চায় আল্লাহকে ও বিশ্বাসীদের, কিন্তু তারা নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয় এবং তারা তা বুঝে না। (সূরা বাকারা : ০৯)

লোক দেখানো সবচেয়ে বেশি ঘটে - যেভাবে মানুষ অন্যের দিকে তাকায়, কথা বলে, খায়, পান করে, কোন জায়গায় আগমন করে, যেভাবে অন্যের সাথে বসে, পোষাক পরে, হাসে এবং যেভাবে তারা নামাজ পড়ে, হজ¦ করে, জিহাদ করে, কোরআন তেলাওয়াত করে এবং যেভাবে সবধরনের বাহ্যিক ইবাদত করে। কিন্তু যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি আন্তরিক, যে তাঁকে অন্তরে ভয় করে এবং যে নিজেকে সব প্রচেষ্টার পরও পিছিয়ে আছে দেখতে পায় সে এর ফলাফল হিসাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে পাবে তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং সে তাদের একজন হবে যারা লোক দেখানো ও মোনাফেক্বী থেকে মুক্ত হওয়ার আশা রাখে, তবে এ শর্তে যে সে ঐ অবস্থায় পথ চলতে থাকে।

 সত্যবাদিতা

সত্যবাদিতা একটি নূর যা এর পৃথিবীতে বাস্তবে আলো বিকিরণ করে: এটি সূর্যের মত, যার বাস্তবতা থেকে  সব কিছু আলো খোঁজে, এ বাস্তবতায় কোন হ্রাস পাওয়া ছাড়াই। প্রকৃতপক্ষে একজন সত্যবাদি ব্যক্তি প্রত্যেক মিথ্যাবাদিকে বিশ্বাস করে তার সত্যবাদিতার বাস্তবতার কারণে। এর অর্থ হলো সত্যবাদিতার বিরোধী কোন কিছু - এমনকি যা সত্যবাদিতা নয় তাও এর সাথে একই জায়গায় বাস করতে অনুমোদিত, যা আদমের ক্ষেত্রে ঘটেছিল -  সে ইবলিসকে বিশ্বাস করেছিল যখন সে মিথ্যা বলেছিল। ইবলিস মিথ্যা শপথ করেছিল আর আদমের ভিতরে কোন মিথ্যা কথা ছিল না। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, আমরা তার ভিতরে দৃঢ়তা পাই নি। (সূরা ত্বোয়া-হা : ১১৫)

 কারণ ইবলিস এমন কিছু আবিষ্কার করেছিল যা আগে জানা ছিল না, প্রকাশ্যেও এবং গোপনেও। ইবলিসকে হাজির করা হবে তার মিথ্যার সাথে এবং সে কখনই আদমের সত্যবাদিতা থেকে লাভবান হবে না। অথচ তা থেকে আদম লাভবান হয়েছে, যে ইবলিসের মিথ্যা কথা বিশ্বাস করেছিল যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সাক্ষ্য দিয়েছেন তার জন্য যখন তিনি বলেছেন যে সে (আদম) অনড় থাকতে পারেনি সে বিষয়ে যা তাঁর আচরণের বিপরীত ছিল। তা প্রকৃতপক্ষে এটিই বুঝায় যে তার নির্বাচিত হওয়া শয়তানের মিথ্যাতে হারিয়ে যায় নি।

সত্যবাদিতা হচ্ছে সত্যবাদির বৈশিষ্ট্য। সত্যবাদিতার বাস্তবতা দাবি করে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর বান্দাহকে পবিত্র করবেন যে রকম তিনি ঈসার (আঃ) সত্যবাদিতা সম্পর্কে  উল্লেখ করেছেন - যা ঘটবে বিচার দিনে। তিনি তা ইঙ্গিত করেছেন মুহাম্মদ (সাঃ)- এর সম্প্রদায়ের সত্যবাদী লোকদের নির্দোষতা উল্লেখ করে। তিনি বলেছেন, আজ সেইদিন যেদিন সত্যবাদীদের জন্য তাদের সত্য লাভ বয়ে আনবে। (সূরা মায়িদা : ১১৯)

        আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, সত্যবাদীতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একটি তরবারী - তাঁর আকাশে ও পৃথিবীতে; প্রত্যেক জিনিসকে তা কেটে ফেলে যাকে তা স্পর্শ করে। তুমি যদি জানতে চাও তুমি সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী, তাহলে তুমি সত্যবাদীতা বলতে বুঝাও ও এজন্য তোমার দাবির সব কিছুর দিকে তাকাও। এরপর এ দুটোকে ওজন করো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে একটি পাল্লাতে, যেন এমন যে তুমি হাশরের দিনে উপস্থিত আছো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, এবং সেদিনে মাপ হবে নিখুঁত। (সূরা আরাফ : ০৮)

        তুমি যা বুঝাতে চাও তাতে যদি সাম্য ও যথার্থতা থাকে তাহলে তোমার দাবি সফল এবং তোমার সত্যবাদীতা সত্য, যখন জিহ্বা হৃদয়ের সাথে ভিন্নমত রাখে না এবং না হৃদয় জিহ্বা - এর সাথে ভিন্নমত রাখে। এ বর্ণনায় সত্যবাদী ব্যক্তি হলো সেই ফেরেশতার মতো যে তার আত্মাকে বের করে আনে; যদি আত্মাকে বের করে আনা না হয় তাহলে সে আর কী করবে?

ইখলাস (বিশুদ্ধ আন্তরিকতা)

প্রত্যেক সম্মানিত কাজের ভিতরে ইখলাস রয়েছে। এটি একটি মনোভাব যা শুরু হয় গ্রহন (ক্ববুল হওয়া) দিয়ে এবং শেষ হয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টি দিয়ে। অতএব যার কাজ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা গ্রহন করেন এবং যার উপরে তিনি সন্তুষ্ট সে হচ্ছে মুখলেস ব্যক্তি, তার কাজের পরিমাণ খুব কম হওয়া সত্তে¡ও। যার কাজ গৃহীত হয় না সে মুখলেস নয়, তার কাজের পরিমাণ বেশি হওয়া সত্তে¡ও। যেভাবে আমরা দেখি আদম (আঃ)  ও ইবলিস (তার উপর লানত) - এর মাঝে কী ঘটেছিল।

ক্ববুল হওয়ার নিদর্শন হচ্ছে সত্যবাদিতা এবং সঠিকতার উপস্থিতি - যা আশা করা হয় সব কিছু ব্যয় করার পর, প্রত্যেক নড়াচড়া ও স্থিরতায় সঠিক সচেতনতা বজায় রেখে। তার যা আছে তা ধরে রাখতে মুখলেস ব্যক্তির সত্ত¡া নিয়োজিত থাকে এবং তার জীবন ব্যয় হয় তার যা আছে তা গুছিয়ে নিতে এবং জ্ঞান ও কাজ এবং কর্মী ও কর্মের মধ্যে ঐক্য আনতে। যদি সে তা অর্জন করে থাকে তাহলে সে সব অর্জন করেছে এবং যদি সে তা হারায়  তাহলে সে সব হারায়; এবং তা বাস্তবায়িত হয় তাঁর একত্বে শিরকহীনতার (তানযিহ) অর্থকে পবিত্র করার মাধ্যমে। যেমন হযরত আলী (রা) বলেছেন, যারা কাজ করে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা ইবাদত করে; যারা ইবাদত করে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা জানে; যারা জানে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা সত্যবাদী; যারা সত্যবাদী তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা মুখলেস (আন্তরিক); যারা মুখলেস তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা মুত্তাক্বী (সতর্ক); যারা মুত্তাক্বী তারা ধ্বংস হয়ে যাবে তারা ছাড়া যারা নিশ্চিত (ইয়াক্বীন) হয়েছে; এবং যারা নিশ্চিত হয়েছে তারা সুমহান চরিত্রের; যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, এবং তোমার রবের দাসত্ব করো ঐ পর্যন্ত যখন তোমার ইয়াক্বীন এসে যায়। (সূরা হিজ্র : ৯৯)

একদম নিচের ইখলাস হলো যখন বান্দাহ নিজের উপর চাপ প্রয়োগ করে যতটুকু তার পক্ষে সম্ভব এবং এরপর সে তার কাজের কোন মূল্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে বলে মনে করে না যে কারণে সে তার রবকে তার কাজের পুরস্কার দিতে বলবে তার জ্ঞান অনুযায়ী, কারণ যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে দাসত্বের (উবুদিয়্যাহ) সব দায়িত্ব পালন করতে বলেন তখন সে তা করতে পারবে না। মুখলেস ব্যক্তির সর্বনিম্ন মাকাম হলো এ পৃথিবীতে সব অন্যায় কাজ থেকে নিরাপত্তা এবং আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া এবং পরবর্তী পৃথিবীতে জান্নাত পাওয়া।

কিন্তু যখন সে তার নিজের অন্যায় কাজগুলো ভুলে যায় এবং নিজের ত্রুটিগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং তার ক্ষমতা ও শক্তিতে পিছিয়ে পড়ে, সে কখনো সফল হবে না।





Reactions

Post a Comment

0 Comments