পরিচ্ছেদ : আঠারো (কাজ করায় অনীহা, ধোঁকা, মোনাফিক্বদের বর্ণনা, সঠিক সামাজিক লেনদেন, দেয়া ও নেয়া)

 

কাজ করার অনীহা

যে ব্যক্তি কাজ করতে অনীহা বোধ করে সে কাজ শুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়, যদি এমনও হয় সে ভালো কাজ করে; আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কাজ করে সে শুদ্ধ, সে ভুল করলেও। অনীহাপূর্ণ ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত ঘৃণা কুড়ায় এবং কাজ করার সময় সে মানসিক ক্লান্তি, পরিশ্রান্ত এবং দুর্দশায় পড়ে। অনীহাপূর্ণ ব্যক্তির  বাইরের সত্তা লোক দেখানো এবং তার অভ্যন্তরীণ সত্তা হলো কপটতাঃ এগুলো তার পাখা যা দিয়ে  সে উড়ে। অনীহাপূর্ণ ব্যক্তির ভেতরে কখনোই সৎকর্মশীলদের কোন গুণাবলী থাকে না, আর না থাকে বিশ্বাসীদের কোন নিদর্শণ, সে যেখানেই থাকুক।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর রাসূলকে (সা) বলেছেন, “ বলো, আমি এর জন্য কোন পুরস্কার চাই না, না আমি তাদের একজন যারা অনীহা নিয়ে কাজ করে।” ( সূরা সাদ ঃ ৮৬)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেণ, “ আমরা নবীরা (সাঃ) ভয়ের সাথে সচেতন, আমানত বহনকারী, আমরা অনীহাপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি।” তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ভয় করো এবং কাজে অনীহাকে বিদায় করে দাও এবং এটি তোমার উপর  বিশ্বাসের চিহ্ন এঁকে দেবে। তা নিয়ে ব্যস্ত থেকো না যার পোশাক হচ্ছে দুঃখ-কষ্ট এবং খাবার নিয়ে যা শেষ পর্যন্ত খালি হয়ে যাবে, কোন বাসস্থান নিয়ে তার শেষ হচ্ছে ধ্বংস, সম্পদ নিয়ে যার শেষ হলো অন্য কেউ এর উত্তরাধিকারী হবে, সাথীদের নিয়ে - যাদের কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত অবশ্যই ছুটি নিতে হবে, সম্মান নিয়ে যার শেষ আছে মর্যাদাশূণ্যতা, আনুগত্য নিয়ে যার শেষ হলো পরিত্যক্ত হওয়া অথবা একটি জীবন নিয়ে শেষ হলো যার দুঃখ। 


ধোঁকা

যে ব্যক্তি ধোঁকা খেলো সে এ পৃথিবীতে হতভাগ্য এবং আখেরাতে প্রতারিত, কারণ সে উত্তমকে বিক্রি করেছে অধমের বিনিময়ে। নিজেকে প্রশংসার চোখে দেখো না। কোন কোন সময় তুমি প্রতারিত হতে পারো তোমার সম্পত্তি ও শারীরিক স্বাস্থ্যের কারণে এ ভেবে যে তুমি চিরদিন টিকে থাকবে।কোন কোন সময় তুমি ধোঁকা খাও তোমার দীর্ঘ জীবন, তোমার সন্তান-সন্ততি এবং বন্ধুদের কারণে যেন তুমি এগুলোর কারণে রক্ষা পাবে। কোন কোন সময় তুমি ধোঁকা খাও তোমার সৌন্দর্য দেখে এবং তোমার জন্মের সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে, যা তোমাকে আশা ও আকাঙ্খা জাগায় এত সহজেই যে তুমি ভাবো তুমি সত্যবাদী ও তোমার লক্ষ্য অর্জনে সফল। কোন কোন সময় তুমি ধোঁকা খাও অন্যদের সামনে তোমার ইবাদতের ক্রুটিগুলো নিয়ে দুঃথ করে, কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জানেন ঠিক এর উল্টোটি আছে তোমার অন্তরে। কোনা কোন সময় ‍তুমি নিজেকে ইবাদত করতে বাধ্য করো অনীহা থাকাকালে; অথচ আল্রাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা চান ইখলাস ( আন্তরিকতা)। মাঝে মাঝে তুমি মনে করো তুমি আল্লাহকে ডাকছো অথচ তুমি ডাকছো অন্যকে। কখনো তুমি মনে করো তুমি লোকজনকে ভালো উপদেশ দিচ্ছো অথচ তোমার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে যে তারা তোমার প্রতি মাথা নত করুক।কোন কোন সময় তুমি নিজেকে দোষারোপ করো অথচ প্রকৃতপক্ষে তুমি নিজের প্রশংসা করছো।

জেনে রাখো তুমি তখনই শুধু ধোঁকা ও আকাঙ্খার অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসবে যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি ফিরবে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়ে, তাঁর বিষয়ে ‍তুমি যা কিছু জানো তার দিকে এবং তোমার নিজের ভেতরের সেই ক্রটিগুলো চিহ্নিত করতে পারবে যা তোমার বুদ্ধি ও জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং যা ঈমান, আইন (শারীয়াহ), রাসূল (সাঃ) - এর সুন্নাহ এবং হেদায়েতের ইমামরা সহ্য করেন না।

যদি তুমি তোমার বর্তমান অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো, তাহলে তোমার চেয়ে জ্ঞান ও কাজকর্মে বেশি হতভাগ্য আর কেউ নেই; না আছে কারও এর চেয়ে অর্থহীন জীবন। তুমি কিয়ামতের দিনে উত্তরাধিকার হিসেবে শুধুই দুঃখ পাবে।

মোনাফিক্বদের বর্ণণা

মোনাফিক্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমত থেকে বহুদূরে থাকার কারণে সন্তুষ্ট থাকে, কারণ তার বাইরের কর্মকাণ্ড ইসলামী আইন অনুযায়ী থাকে, কিন্তু এরপরেও সে ভ্রুক্ষেপহীন এবং নিষ্ফল টিটকারী করে এবং তার অন্তরে এর সত্যতার সীমা লঙ্ঘন করে।

মোনাফেক্বির চিহ্ন হচ্ছে মিথ্যাকে কিছু মনে না করা, প্রতারণা, ঔদ্ধত্য, মিথ্যা দাবী, আন্তরীকতাহীনতা, নির্বুদ্ধিতা, ভুল এবং বিনয়ের অভাব, অবাধ্যতাকে হালকা করে দেখানো, বিশ্বাসীরা যেন বিশ্বাস হারায় তা চাওয়া, এবং বিশ্বাসে  দুর্দশাকে হালকা করে দেখানো, অহংকার, প্রশংসা, প্রেমের প্রশংসা, প্রশংসাকে ভালোবাসা, ঈর্ষা, আখিরাতের চাইতে পৃথিবীকে এবং খারাপকে ভালোর চাইতে পছন্দ করা, অপবাদ দেয়াতে উষ্কানী দেওয়া, আনন্দ-ফুর্তিকে ভালোবাসা, কথায় যারা শঠ তাদের সাথে লেনদেন করা, উদ্ধত লোকদের ভালো কাজ এড়িয়ে যাওয়াতে সাহায্য করা, যারা ভালো কাজ করে তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, মোনাফিক্ব যে খারাপ কাজ করে তাকে ভালো মনে করা এবং অন্যলোক যা ভালো করে তাকে ঘৃণ্য মনে করা এবং এরকম আরো অনেক জিনিস।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মোনাফিক্বদের বেশ কয়েক জায়গায় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “ এবং মানুষের মাঝে সে আছে যে আল্লাহর দাসত্ব করে কিনারে দাঁড়িয়ে। এতে যদি তার কোন কল্যাণ হয় সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, কিন্তু কোন পরীক্ষা তাকে কষ্ট দিলে সে উল্টো দিকে ফিরে যায়; সে হারায় এ দুনিয়া ও আখিরাত; আর এটাতো স্পষ্ট ক্ষতি।” ( সূরা হাজ্জ ঃ ১১)

তাদের বর্ণনা করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “কিছু মানুষ আছে যারা বলেঃ‘ আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহতে এবং আখিরাতে।’ কিন্তু তারা মোটেও বিশ্বাসী নয়। তারা চায় আল্লাহ ও বিশ্বাসীদের ধোঁকা দিতে, কিন্তু তারা শুধু নিজেদেরকে ধোঁকা দেয় অথচ তারা তা বোঝে না। তাদের অন্তরগুলোতে একটি রোগ আছে, তাই আল্লাহ তাদের রোগ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন।” ( সূরা বাকারা ঃ ৮ - ১০)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ মোনাফিক্ব সে, যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে তাঙ্গে; যখন সে কোন কাজ করে সে খারাপ কাজ করে, যখন সে কথা বলে, সে মিথ্যা বলে; যখন তাকে বিশ্বাস করা হয়, সে বিশ্বাসঘাতকতা করে; যখন তাকে রিযক দেওয়া হয়, সে হয় লাগামহীন; যখন তা স্থগিত রাখা হয় তখন সে তার জীবন নিয়ে বড় কথা বলে।”

তিনি আরও বলেছেন, “ যে ব্যক্তির গভীরতম সত্তা তার প্রকাশ্য চেহারার বিরোধিতা করে সে মোনাফিক্ব - সে যেই হোক, যেখানেই সে থাকুক, যে যুগেই সে বাস করুক এবং যে পদমর্যাদাই তার থাকুক।”

সঠিক সামাজিক লেনদেন

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অবাধ্য না হয়ে তাঁর সৃষ্টির সাথে সঠিক আচরণ আসে তাঁর বান্দাহদের উপর তাঁরই নেয়ামতের উপর বৃদ্ধি থেকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি অন্তরে বিনয়ী সে প্রকাশ্যে ভালো আচরণ করে। 

লোকজনের সাথে ভালো আচরণ করো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কারণে, এ পৃথিবী থেকে কোনো অংশ পাওয়ার জন্য নয় অথবা সম্মানের খোঁজে নয় অথবা লোক দেখানোর জন্য অথবা তোমার খ্যাতি বৃদ্ধির জন্য নয়।

আইনের সীমা লঙ্ঘন করো না মর্যাদা ও সুখ্যাতি চেয়ে; এগুলো তোমাকে কোন লাভ এনে দেবে না এবং ‍তুমি আখেরাত হারাবে কোন লাভ ছাড়াই।


দেয়া ও নেয়া

যে ব্যক্তি দেয়ার চাইতে নেয়াকে বেশি পছন্দ করে সে প্রতারিত হয়েছে, কারণ তার ভ্রক্ষেপহীন স্বভাবের কারণে সে মনে করে যে, ‘ যা এখন সেটি পরে যা আসবে তার চাইতে ‍উত্তম। বিশ্বাসীর জন্য এটিই শোভা পায় যে যখন সে কিছু নিবে তা সে বৈধভাবে নিবে। যদি সে দেয় তাহলে তা হওয়া ‍্উচিত যথার্থ কারণে, বৈধভাবে এবং তার বৈধ সম্পদ থেকে। কত গ্রহনকারীই না তার ঈমানকে ত্যাগ করে, অথচ সে সম্পর্কে খবর রাখে না! যারা দেয় তাদের কতজনই না নিজের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার গযব ডেকে আনো।

বিষয়টি শুধু দেয়া ও নেয়ার প্রশ্ন নয় বরং সে ব্যক্তি রক্ষা পেলো যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে দেয়া ও নেয়ার সময় ভয় করলো এবং যে সৎকর্মশীলতার রশিতে শক্ত করে ধরে রাখে।

এ বিষয়ে মানুষ দুই শ্রেণিরঃ ্উচ্চ শ্রেণি ও সাধারণ। উচ্চ শ্রেণির লোকেরা কষ্টকর সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে এবং নেয় না যতক্ষণ না সে নিশ্চিত হয় যে তা অনুমোদিত। যদি তা তার কাছে স্পষ্ট না হয় তাহলে সে শুধু বাইরের দিকটি বিবেচনা করে; সে তা নেয় যা সে দেখে চরি করা নয় অথবা জবরদস্তির সাথে নেয়া হয় নি  এবং বলে ‘ এতে কোন ক্ষতি নেই; এটি আমার জন্য অনুমোদিত।’ এখানে বিষয়টি পরিস্কার যে সে তা নেয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রায় থাকার কারণে এবং খরচ করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য।

Reactions

Post a Comment

0 Comments