পরিচ্ছদ : সাত ( ‍যিকর, ক্বারীদের ধ্বংস, সত্য যাচাই ও মিথ্যা, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর আধ্যাত্নিক জ্ঞান)


 যিকর

যে সত্যিকারভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে স্মরণ করে সে তাঁকে মেনে চলে। যে ভূলে যায় সে অবাধ্য। আনুগত্য হেদায়েতের চিহ্ন। অবাধ্যতা পথভ্রষ্টতার চিহ্ন। এ দুই অবস্থার মধ্যে রয়েছে ‍যিকর (স্মরণ) এবং ভুলে যাওয়া। তোমার অন্তরকে তোমার জিহ্বার মনোযোগের কেন্দ্র বানাও - যার নড়াচড়া করা উচিত নয় যদি না অন্তর ইঙ্গিত করে ও বুদ্ধি একমত হয় এবং জিহ্বা বিশ্বাসের সাথে মিল রাখে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জানেন তুমি কী লুকাও এবং তুমি কী প্রকাশ করো।

তার মত হও যার আত্মা তার দেহ থেকে ঝরে গেছে অথবা তার মত যে হিসাব দিনের মহাসমাবেশে যোগদান করছে - তাঁর প্রতিশ্রুতি ও তাঁর হুমকি এবং তোমার রব তোমার উপরে যে আদেশ ও নিষেধ জারি করেছেন তা পালন করার ব্যাপারে মনোযোগ না হারিয়ে। নিজেকে নিয়ে বিভোর থেকো না বরং তোমার রব তোমাকে যে  দায়িত্ব দিয়েছেন তা নিয়ে ব্যস্ত হও। তোমার অন্তরকে দুঃখ ও ভয়ের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলো।আল্রাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ‍যিকরকে তোমার জন্য তাঁর মহান স্মরণের অংশ বানাও।  তিনি তোমাকে স্মরণে রাখেন কিন্তু তোমাকে তাঁর কোন প্রয়োজন নেই। তুমি তাঁকে যে স্মরণ করো তাঁর চাইতে তোমাকে তাঁর স্মরণ আরো মহান, আরো আকর্ষণীয়, আরো প্রশংসনীয় এবং আরো সম্পূর্ণ ও আরো প্রাচীন।

তোমাকে তিনি স্মরণ করার কারণে যে জ্ঞান তুমি লাভ করো তা তোমার ভিতরে বিনয়, ভদ্রতা এবং অনুতাপের জন্ম দিবে। পরিণতিতে তা তোমাকে তাঁর উচ্চ মর্যাদা এবং উপচে পড়া পূর্ববর্তী দান সমূহ দেখতে সাহায্য করবে। তা তোমার আনুগত্যকে তোমার চোখেই তুচ্ছ হিসেবে দেখাবে, তাঁর নেয়ামতের কারণে তা যত বড়ই হোক, এবং তুমি তাঁর প্রতি আন্তরিকভাবে আত্মনিয়োগ করবে। কিন্তু তাঁকে তোমার স্মরণ করার বিষয়ে তোমার চেতনা ও সম্মানবোধ তোমাকে লোক দেখানো, অহংকার, মূর্খতা এবং তোমার চরিত্রের রুক্ষতার দিকে ঠেলে দিবে। এর অর্থ হলো (তার প্রতি) তোমার আনুগত্যকে খুব বেশি মর্যাদা দেওয়া অথচ তাঁর ্উপচে পড়া নেয়ামত ও উদারতাকে ভুলো যাওয়া।

এটি তোমাকে তাঁর কাছ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিবে এবং চলে যেতে থাকা দিনগুলোতে তুমি যা অর্জন করবে তা হবে শুধুই একাকীত্ব। দু’ধরনের ‍যিকর আছে। তা হলো; ক) আন্তরিক যিকর যেখানে অন্তর হয় প্রশান্ত এবং  খ)  সে ‍যিকর যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর স্মরণকে বিতাড়িত করে।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ আপনার যথাযথ প্রশংসা করাতে আমি ন্যায় বিচার করতে অক্ষম যেভাবে আপনি নিজে নিজের প্রশংসা করেছেন।”  রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে স্মরণ করার বিষয়ে কোনো সীমানা নির্ধারণ করেন নি। যেহেতু  তিনি এ সত্য জানতেন যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বান্দাহ তাঁর যে স্মরণ করে তার চাইতে উত্তম হচ্ছে বান্দাহকে তাঁর স্মরণ। তাই এটি আরো যথাযোগ্য যে যে-ই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর পরে আসবে সে যেন কোন সীমানা নির্ধারণ না করে এবং যে আল্লাহকে স্মরণ করতে চায় তার জানা থাকা উচিত যে যতক্ষণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর বান্দাহকে তাঁর স্মরণ করাতে সফলতা না দিবেন ততক্ষণ বান্দাহ তাঁকে স্মরণ করতে অক্ষম হবে।

ক্বারীদের ধ্বংস

যে ব্যক্তি জ্ঞান ছাড়া তেলাওয়াত করে সে হচ্ছে সেই দেউলিয়া লোকের মত যার না আছে সম্পত্তি না আছে সম্পদ; কারণ জনগণ কাউকে ঘৃণা করে না সহায়-সম্পত্তি না থাকার কারণে, বরং তারা তাকে ঘৃণা করে তার অহংকার- এর কারণে। সে সব সময় সৃষ্টির সাথে ঐ বিষয়ে দ্বন্দ্বে আছে যা তার উপরে বাধ্যতামূলক নয় এবং যে সৃষ্টির সাথে বিরোধিতায় জড়ায় যে বিষয়ে তাকে আদেশ করা হয়নি, সে সৃষ্টি প্রক্রিয়া এবং পরম প্রভুত্বের বিরোধিতায় লিপ্ত আছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “ মানুষের মাঝে সে আছে যে আল্লাহর বিষয়ে তর্ক করে কোন জ্ঞান, কোন হেদায়েত এবং আলোদানকারী কোন কিতাব ছাড়াই।” (সুরা লুকমান ঃ ২০)

কেউ সে ব্যক্তির চাইতে কঠোর শাস্তি পাবে না যে জ্ঞানের চাদরের উপর অধিকার দাবি করে অথচ তার কাছে না আছে সত্য, না আছে এর অর্থ। যাইদ ইবনে সাবিত তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, “ হে আমার পুত্র, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেন তোমার নাম অর্থহীন তেলাওয়াতকারীদের তালিকায় না দেখেন।” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ এমন একটি সময় আমার উম্মতের কাছে আসবে যখন তেলাওয়াতকারীর নাম শোনা অধ্যায়নের চাইতে উত্তম বিবেচিত হবে এবং অধ্যয়ন বিবেচিত হবে অভিজ্ঞতাসহ কাজ করার চাইতে উত্তম.... আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মোনাফেক্ব হলো কোরআনের ক্বারীদের মধ্যে।”

সেখানেই থাকো - যেখানে থাকার জন্য তোমার বিশ্বাস তোমাকে পরামর্শ দেয় এবং যেখানে তোমাকে থাকতে আদেশ করা হয়। যতটুকু পারো নিজের ভিতরের অবস্থা অন্যদের কাছে গোপন করো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি তোমার আনুগত্যপূর্ণ কাজগুলোকে এমন বানাও যেমন তোমার আত্মা তোমার দেহের সাথে সম্পর্ক রাখে, যেন সেগুলো হয় তোমার অবস্থার  ইঙ্গিত যা তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তার মাঝে অর্জন করেছো।তোমার সব বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাহায্য চাও এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে বিনয়ের সাথে প্রার্থনা করো রাতের শেষে ও দিনের শেষে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, “ তোমাদের রবকে ডাকো বিনয়ের সাথে ও গোপনে, নিশ্চয়ই তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের  ভালোবাসেন না।” ( সুরা আরাফ ঃ ৫৫)

সীমালঙ্ঘন হচ্ছে আমাদের যুগে ক্বারীদের চরিত্রের একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। তোমার সব বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ভয় করো। যেন তুমি কামনা-বাসনার কবলে না পড় এবং নিজেকে ধ্বংস করে না ফেলো।

সত্য যাচাই ও মিথ্যা

আল্রাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে ভয় করো এবং তুমি যেখানে এবং যে লোকদের মাঝে চাও - থাকো। যে সতর্কতা অবলম্বন করে তার জন্য পারস্পারিক দ্বন্দ্ব নেই। সতর্কতা অবলম্বন সব দলের জন্যই কাম্য। এতে রয়েছে সব কল্যান ও প্রজ্ঞা। এটি প্রত্যেক প্রহণযোগ্য আনুগত্যপূর্ণ কাজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাপ। সতর্কতা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মারেফাতের ঝরণা থেকে বেরিয়ে আসা পানি ঃ জ্ঞানের প্রত্যেক শাখা এর প্রয়োজনে রয়েছে। কীভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ভয়ে ও তাঁর শক্তির ভয়ে চলৎশক্তি রহিত হয় তা জানার জন্য কোন সত্যায়নের প্রয়োজন নেই। সতর্কতায় ‍বৃদ্ধি ঘটে তাঁর বান্দাহদের গোপন বিষয়গুলোর সাথে তাঁর গোপন করুণার পরিচয় করিয়ে দেয়ার কারণে। আর এটিই প্রত্যেক সত্যের মূল।

            মিথ্যা হলো যা কিছু তোমাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে কেটে দেয়। প্রত্যেক দলই এর সাথে একমত। অতএব মিথ্যা পরিত্যাগ করো তোমার গোপনকে আল্রাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি নিবদ্ধ করো কোন পিছুটান ছাড়াই।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ বেদুঈনরা সবচেয়ে বেশি সত্য যা বলেছে তা হলো লাবিদের কথা - যখন সে বলেছে ঃ নিশ্চয়েই আল্লাহ ছাড়া সব কিছু মিথ্যা এবং প্রত্যেক নিয়ামত অতি অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী।”

তাই তা আঁকড়ে ধরে থাকো যে বিষয়ে পবিত্র, ধার্মিক এবং সতর্ক ব্যক্তিরা ঐক্যমত, আর তা হলো- বিশ্বাসের মূল, ইয়াক্বীনের বাস্তবতা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টি ও আত্মসমর্পণ। জনগণের মাঝে মতভেদ ও বিরোধিতার মাঝে প্রবেশ করো না, কারণ তাহলে তোমার জন্য বিভিন্ন বিষয় কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বাছাইকৃত উম্মত একমত হয়েছে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এক এবং তাঁর মতো কিছু নেই এবং তিনি তাঁর বিচারে ন্যায়পরায়ণ, তাই করেন যা তাঁর ইচ্ছা এবং পরিচালনা করেন যা তাঁর সিদ্ধান্ত।তাঁর কোন সৃষ্টিতে কেউ জিজ্ঞোস করে না ‘কেন?’। কোন কিছু ছিল না এবং কোন কিছু হবেও না যা তাঁর সিদ্ধান্ত ও চাওয়া অনুযায়ী নয়। তাঁর তা করার শক্তি আছে যা তিনি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি ও হুমকিতে সত্যবাদী।

কোরআন হচ্ছে তাঁর কথা এবং তাঁর অস্তিত্ব ছিল জীবিত সত্তা, স্থান ও সময়ের আগে। জীবিত সত্তাগুলোর সৃষ্টি ও সেগুলোর বিলীন হওয়া তাঁর কাছে সমান। তাদের সৃষ্টি তাঁর জ্ঞানের কোন বৃদ্ধি ঘটায় নি এবং তাদের চলে যাওয়া তাঁর রাজ্যে কোন ঘাটতি আনবে না। তাঁর ক্ষমতা পরম এবং তিনি রাজকীয, সমস্ত মর্যাদা তাঁর।

যদি কেউ তোমার কাছে কিছু আনে যা এই মৌলিক সত্যের চাইতে কম হয় তাহলে তা গ্রহণ করো না। তোমার ভিতরের সত্তাকে এর দিকে নিবদ্ধ করো, তুমি এর নেয়ামতকে কাছেই দেখতে পাবে, তুমি বিজয়ীদের একজন হবে।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর আধ্যাত্মিক জ্ঞান (ইরফান)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর রাসুলকে (সাঃ) ও তাঁর পরিবারকে লুৎফ ( গোপন দয়া), উদারতা এবং রহমত এর ভাণ্ডার থেকে দান করেছেন। তিনি সেগুলোকে শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে এবং সমস্ত সৃষ্টির মাঝ থেকে তাঁদেরকে নিজের জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। পুরো সৃষ্টি জগৎ থেকে একজনও তাঁদের অবস্থা ও চরিত্রের অধিকারী নয়, কারণ তিনি তাদেরকে বানিয়েছেন সমস্ত সৃষ্ট প্রাণীদের জন্য তাঁর কাছে আসার মাধ্যম। তিনি তাদের প্রতি আনুগত্য ও তাদের প্রতি ভালোবাসাকে তাঁর সন্তষ্টির কারণ এবং তাদের বিরোধিতা এবং তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করাকে তাঁর ক্রোধের কারণ বানিয়েছেন। তিনি সব মানুষ ও দলকে আদেশ দিয়েছেন তাদের রাসুলকে অনুসরণ করার জন্য, তাদের মাধ্যমে আনুগত্য ছাড়া অন্য  কোন মাধ্যমের আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করার জন্য, তাদের প্রশংসা করার জন্য এবং তাদের আদেশ করেছেন তাদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান প্রদর্শণ ও তাদের কাছে আত্মসমর্পণ এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে তাদের উচ্চ মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য।

অতএব সবাই আল্লাহর রাসুলের (তাঁর ও তাঁর পরিবারের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) প্রশংসা করো এবং তাদেরকে তাদের চাইতে নীচে কোন ব্যক্তির সমান মর্যাদা দিয়ো না। তাদের মাক্বাম, অবস্থা ও চরিত্র সম্পর্কে তোমার বুদ্ধি  খাটিও না যদি না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে তা পরিস্কার তথ্য হয় এবং যাদের অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে তাদের ঐক্যমত হয় সে প্রমাণসমূহের উপরে যেগুলো তাদের মূল্য ও মর্যাদার সাক্ষ্য দেয়। কীভাবে তুমি সেই বাস্তবতা বুঝতে পারবে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে তারা পেয়েছে? যদি তুমি তাদের কথা এবং কাজকে তাদের চাইতে নীচে কোন ব্যক্তির সাথে তুলনা করো তাহলে তুমি তাদের খারাপ সাথী হবে, এবং তুমি অজ্ঞতার কারণে তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে ও তারা যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কর্তৃক বিশেষভাবে বাচাইকৃত তা অস্বীকার করবে এবং তুমি বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের স্তর থেকে নীচে পড়ে যাবে। তাই সতর্ক হও এবং আবারও সতর্ক হও।





Reactions

Post a Comment

0 Comments