পরিচ্ছেদ : বারো ( তওবা, নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, নিরব থাকা, বুদ্ধি ও কামনা-বাসনা)


তওবা

তওবা হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রশি এবং তাঁর বান্দাহদের জন্য তাঁর মনোযোগের প্রধান মাধ্যম যাদেরকে অবশ্যই অনুতপ্ত থাকতে হবে প্রত্যেক অবস্থায়। বান্দাহদের প্র্রত্যেক দলেরই রয়েছে এর নিজস্ব ধরনের তওবা।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর তওবা হচ্ছে বাইরের বিরক্তি উদ্রেককারী উৎসের কারণে ভেতরের গভীরতম সত্তায় যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তার জন্য এবং আউলিয়াদের তওবা আসে তাদের চিন্তার রঙে পরিবর্তন ঘটা থেকে, পরিশুদ্ধদের (আবরার) তওবা নিহিত থাকে তাদেরকে যা সামান্যতম পীড়ন করে তা শান্তভাবে পরিত্যাগ করার ভেতরে, উচ্চস্থানীয়দের তওবা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এবং সাধারণ মানুষের তওবা অন্যায় কাজের কারণে। এদের প্রত্যেকই তাদের তওবার কারণ ও উদ্দেশ্য জানে এবং সে সম্পর্কে সচেতন।  কিন্তু এখানে এসব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে তাদের দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে।

সাধারণ মানুষের তওবা হলো সে তার অভ্যন্তরীন সত্তাকে অনুতাপের পানি দিয়ে ধোয়া এবং তার ভুল কাজকে সর্বক্ষণ স্বীকার করে।সে যা করেছে তার জন্য দুঃখ করে এবং তার জীবনের যতটুকু বাকি আছে তা নিয়ে ভয় করে। সে তার অন্যায় কাজগুলোকে সামান্য ভাবে না যে, সে ক্ষেত্রে তা তাকে অলসতার দিকে নিয়ে যাবে; সে যা হারিয়েছে তার জন্য তার ক্রমাগত কান্না এবং দুঃখ করাটাও একটি ইবাদত। তার উচিত নিজেকে পৃথিবীর ক্ষুধা থেকে বিরত রাখা এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাহায্য চাওয়া তওবা করার জন্য এবং সে কাজ আবার করা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য যা সে আগে করেছে। সে নিজেকে অজ্ঞতা ও ইবাদতের উঠানে প্রশিক্ষণ দেয়।সে বাধ্যতামূলক কাজগুলো যেগুলো সে আগে করেনি তা পূরণ করে।সে সাহায্যের জন্য অন্যদের ডাকে সাড়া দেয়, অসৎ সঙ্গ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, রাতে জেগে কাটায়, দিনের বেলায় পিপাসার্ত থাকে, তার শেষ পরিণতির উপরে সর্বক্ষণ ভাবে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে সাহায্য চায়, তাঁর কাছে অনুরোধ করে আরাম ও দুঃসময়ে তাকে দৃঢ় রাখার জন্য এবং তাকে পরীক্ষা ও দুঃখ দুর্দশায় স্থির রাখার জন্য সে তওবাকারীদের মাক্বাম থেকে নীচে পড়ে না যায়। এটি তাকে তার অন্যায় কাজ থেকে পবিত্র করবে, তার জ্ঞান বৃদ্ধি করবে এবং তার মর্যাদা উঁচুতে উঠানো হবে। যেভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, “ আর আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে জেনে নিবেন কারা সত্যবাদী এবং অবশ্যই জেনে নিবেন মিথ্যাবাদীদের।” ( সূরা আনকাবুত : ০৩)

নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া (উযলাহ)

যে ব্যক্তি পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়লা তাকে দূর্গের ভেতর নেন এবং নিরাপত্তা দেন অভিভাবকত্বের (বেলায়েতের) মাধ্যমে। যে ব্যক্তি নিজেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর কাছে গুটিয়ে নিয়েছে তার কীইনা আনন্দ! এটি করার জন্য তাকে অবশ্যই পার্থক্য করতে হবে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে, দারিদ্রকে ভালোবাসতে হবে, দুঃখ-কষ্ট এবং বিরত থাকাকে বেছে নিতে হবে এবং নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার প্রত্যেকটি সুযোগ গ্রহন করতে হবে। সে অবশ্যই তার প্রত্যেকটি কাজের ফলাফল নিয়ে ভাববে, ইবাদত করবে যত বেশি সম্ভব, অহংকার পরিত্যাগ করবে এবং সর্বক্ষণ যিকর-এ নিয়োজিত থাকবে উদাসীনতা ছাড়া- যা হলো শয়তানের শিকারের ভূমি এবং প্রত্যেক দুর্দশার শুরু, আর যা কিছু অস্পষ্ট তার কারণ। তার উচিত তার বাড়ি থেকে সব কিছু বিদায় করে দেয়া যার শীঘ্রই কোন প্রয়োজন নেই।

ঈসা (আঃ) বলেছেন, “ তোমার জিহ্বাকে পাহারা দাও যেন তোমার অন্তরে উন্নয়ন ঘটাতে পারো এবং তোমার বাসস্থানকে তোমার জন্য যথেষ্ট বানাও। লোক দেখানো এবং অতিরিক্ত রিযক থাকা থেকে সাবধান থাকো। তোমার রবের সামনে নম্র হও এবং ভুলের জন্য কাঁদো।লোকজন থেকে পালাও যেভাবে তুমি পালাও সিংহ ও বিষাক্ত সাপ থেকে। সেগুলো ছিল ্ঔষধ এবং ্এখন সেগুলো রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে সাক্ষাত করো যেখানে তুমি চাও।” রাবি ইবনে কুসাইম বলেছিলোঃ “ যদি তুমি আজ এমন কোন স্থানে যেতে পারো যেখানে তুমি কাউকে চেনো না এবং যেখানে তোমাকে কেউ চেনে না তাহলে তাই করো।”

নিজেকে গুটিয়ে নিলে তা আনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য নিরাপত্তা, একটি মুক্ত অন্তর, সুস্থ রিযক, শয়তানের অস্ত্রগুলোর ধ্বংস, প্রত্যেক খারাপকে এড়িয়ে চলা এবং অন্তরের জন্য বিশ্রাম।এমন কোন পবিত্র নবী (আঃ) নেই এবং কোন নবীর ওয়াসী নেই যে তাঁর জীবনে একবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়নি, হয় তার শুরুতে অথবা তার শেষে।

নিরব থাকা

নিরবাত তাদের চিহ্ন যারা সে সব বাস্তবতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে যা ইতোমধ্যেই এসেছে এবং যার বিষয়ে কলম ইতোমধ্যেই লিখেছে।এটি হচ্ছে এ পৃথিবী ও আখেরাতের সব বিশ্রামের চাবি ঃ এটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টি আনে, আমলের হিসাবকে সহজ করে এবং এটি ভুলক্রটি থেকে একটি নিরাপত্তা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এটিকে পর্দা বানিয়েছেন মূর্খদের জন্য এবং অলংকার বানিয়েছেন জ্ঞানীদের জন্য। 

নিরবতার মাধ্যমে কামনা-বাসনাকে এক পাশে সরিয়ে রাখা যায় এবং এর সাথে আসে আত্ম-শৃঙ্খলা, ইবাদতের মিষ্টতা, হৃদয়ের কাঠিণ্য দূরিভূত হওয়া, বিরত থাকা, ধার্মিকতা এবং জ্ঞান ভাণ্ডার।অতএব, তোমার জিহ্বাকে তালা মারো সে কথার উপরে যা অত্যন্ত জরুরী নয়, বিশেষকরে যখন তুমি দেখ তুমি কথা বলার মতো কোন যোগ্যলোক দেখছো না; শুধু তখন ছাড়া যখন তুমি একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে সম্পর্কিত বিষয় কথা বলছো।

রাবি ইবনে কুসাইম একটি মোটা কাগজ তার সামনে রাখতো যার উপরে সে লিখে রাখতো সে দিনের বেলায় কী বলেছে। রাতে সে নিজে নিজের হিসাব  নিতো তার বেঁচে থাকা কালেই।দেখতো সে কী বলছে নিজের পক্ষে এবং নিজের বিপক্ষে। এরপর সে বলতো, “ হায়! যারা নিরব তারা রক্ষা পেয়েছে।” 

রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- এর  একজন সাহাবী তার মুখের ভিতরে  নুড়ি পাথর ভরে রাখতো। যখন সে কিছু বলতে চাইতো তখন যদি সে জানতো তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পথে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য, তখন সে তার মুখের ভিতর থেকে তা বের করতো। সাহাবীদের অনেকেই এমনভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেন যেন মনে হতো কোন ডুবন্ত মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস এবং কথা বলতেন অসুস্থ মানুষের মতো।

মানুষের ধ্বংস বা সাফল্য নিহিত আছে 

তার কথাবার্তা ও নিরবতার মাঝে

সৌভাগ্য তাদের যাদেরকে কথাবার্তায় কী সঠিক ও কী ভুল এ সম্পর্কে এবং নিরবতার বিজ্ঞান ও এর সুবিধাগুলো সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া  হয়েছে।কারণ এটি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) - এর গুণাবলীর একটি এবং নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিশেষ চিহ্ন। যে কথার মূল্য বোঝে সে নিরবতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যদি ব্যক্তিকে নিরবতার সুক্ষ্ম বিষয়গুলো দেখানো হয় এবং এর মূল্যবান ভাণ্ডার তার কাছে গচ্ছিত রাখা হয় তখন তার কথা ও নিরবতা উভয়ই ইবাদত। এ ইবাদতের রহস্য শুধু তিনিই জানেন যিনি সবার বাদশাহ, সর্ববাধ্যকারী আল্লাহ।

বুদ্ধি ও কামনা-বাসনা

বুদ্ধিমান মানুষ যা সত্য তার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তার বক্তব্য হয় ন্যায়পরায়ণ; যা মিথ্যা তা থেকে সে কুঁকড়ে সরে  যায় এবং তার কথায় এর বিরোধীতা করে। সে এ পৃথিবীকে পিছনে ঠেলে দেয় কিন্তু তার বিশ্বাসকে ত্যাগ করে না।

বুদ্ধিমান মানুষের প্রমাণ দু’টো জিনিসে নিহিতঃ সত্য কথা এবং সঠিক কাজ।বুদ্ধিমান মানুষ এমন কিছু বলে না যা বুদ্ধি প্রত্যাক্ষান করে, না সে নিজেকে সন্দেহে পড়তে দেয়, না সে পরিত্যাগ করে তাদের সাহায্য যারা পরীক্ষিত। তার কাজকর্মে জ্ঞান পথ দেখায়; যে পথে সে চলে সেখানে ইরফান (আধ্যাত্নিক জ্ঞান) তার নিশ্চয়তা এবং সহনশীলতা হলো তার সার্বক্ষণিক সাথী। কামনা-বাসনা বুদ্ধির শত্রু, সত্যের প্রতিপক্ষ এবং মিথ্যার সাথী। কামনা-বাসনার শক্তি আসে দুনিয়ার ক্ষুধা থেকে এবং এর প্রাথমিক প্রকাশ হচ্ছে হারাম কাজ করা, দায়িত্বে অবহেলা করা, সুন্নাহকে হালকা করে দেখা এবং আনন্দ ফুর্তিতে মগ্ন হওয়া।
Reactions

Post a Comment

0 Comments